ll ঢাকেশ্বরী মন্দির, কলকাতা ll বাড়ির পাশেই (সিরিজ ৯) ll

2 years ago
1

#কলকাতা #বাগবাজার #বাড়ির_পাশেই #ঢাকেশ্বরী_মন্দির
#bagbazar
#kolkata
#travel

"দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ঘাসের আগার উপর
একটি শিশির বিন্দু"
------ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তাই আমরা 'টোটো কোম্পানি'র তরফে শুরু করেছি নতুন এপিসোড 'বাড়ির কাছেই'। যেখানে খুব কম খরচে একদিনে বা একবেলায় ঘুরে আসা সম্ভব। আর তাছাড়া বাড়ির কাছেই এই বিন্দু বিন্দু মুক্তকণা সংরক্ষণ করা আমাদের কর্তব্য। তাই চলুন দেখে নেওয়া যাক আজকের পর্ব! আজ নবম পর্ব। গন্তব্য ' ঢাকেশ্বরী মন্দির, কলকাতা!
আছে গৌর নিতাই নদীয়াতে কৃষ্ণ আছে মথুরাতে
কালীঘাটে আছে কালী ঢাকেশ্বরী ঢাকায়
আয় গো তোরা দেখবি যদি আয় গো চলে আয়।”।

‘ মোহনার দিকে ‘নামে একটি বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় গানটির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। এই গানে গৌর নিতাই কৃষ্ণ আর কালীর অবস্থান সঠিক জায়গায় হলেও ঢাকেশ্বরী কি সত্যিই ঢাকায় আছেন? অনেকেই জানেন না যে মহানগরী কলকাতার কুমোরটুলির গঙ্গার ধারে মন্দিরে কিন্তু তার অবস্থান। ঢাকায় আছে তাঁর রেপ্লিকা।নয় নয় করে প্রায় ৭২ বছর হয়ে গেল এ শহরে ঢাকেশ্বরী মায়ের অবস্থান।
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, এই মূর্তি ঢাকা শহরের দেবী, কিন্তু কী করে সেটা কলকাতা শহরে এল সেটা নিশ্চই জানতে ইচ্ছে করছে? বলব, তবে তার আগে জেনে নেওয়া যাক, ঢাকেশ্বরী মূর্তির ইতিহাস।

ঢাকার প্রচলিত কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, সেন বংশের রাজা বল্লালসেনের মা যখন অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তখন কোনও কারণে তাঁকে এক উপবনে নির্বাসন দেওয়া হয়। সেই সময়ে তিনি দেবী ঢাকেশ্বরীর পুজো করেন। ওই বনেই এক সময়ে বল্লালসেনের জন্ম হয়। বনের মধ্যে জন্ম হয়েছিল বলে, তাঁর নাম রাখা হয় বনলাল বা বল্লাল। রাজা হওয়ার পর, নিজের জন্মস্থানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি সেই জঙ্গলের গাছ কাটিয়ে ঢাকেশ্বরীর মন্দির তৈরি করে দেন। তবে কেউ কেউ বলেন, এই বল্লালসেন গৌড়ের রাজা নন, ইনি আরাকানরাজ শ্রীসুধর্মর ছোট ভাই মঙ্গতরায় যিনি বল্লাল সেন নামেও স্থানীয় ইতিহাসে পরিচিত। আরকান থেকে বিতাড়িত হয়ে সেই বল্লালসেন ঢাকায় এসেছিলেন।
আবার অন্য এক কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, মুঘল সেনাপতি জাহাঙ্গীর বাংলার বারো ভূঁইয়ার অন্যতম কেদায় রায়কে পরাজিত করে তাঁর গৃহদেবী শিলাময়ী নিয়ে ঢাকায় আসেন। সেখানকার শিল্পীদের দিয়ে আরও একটা মূর্তি তৈরি করতে নির্দেশ দেন। শিল্পীরা আসল মূর্তির সামনে বসে হুবহু এক রকম দেখতে আরও একটা মূর্তি তৈরি করেন এবং নতুন তৈরি মূর্তিটা কোনও এক সুযোগে আসল মূর্তির সঙ্গে পালটা-পালটি করে মানসিংহকে দিয়ে দেন। মানসিংহ নতুন মূর্তি ঢাকায় রেখে, আসল মূর্তিটা জয়পুরে নিয়ে চলে যান।

কলকাতার মানুষ খুব কমই জানেন এই মন্দির বিষয়ে।এ শহরে অনেক দুর্গা মন্দির আছে। কিন্তু এই মন্দির একেবারেই আলাদা তাঁর বর্ষ প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বিগ্ৰহের জন্য ঢাকেশ্বরী দেবীর উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে রয়েছে নানা কিংবদন্তি ।কারো মতে এটি প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো। কেউ আবার মনে করেন যে এটি ২০০ বছরের বেশি পুরনো নয়।রাজা বল্লাল সেনের প্রতিষ্ঠিত নাকি এই দেবী এমনও ধারণা।জঙ্গল থেকে ঢাকা অবস্থায় এই বিগ্ৰহ পেয়েছিলেন বলে এনার নাম ঢাকেশ্বরী।অনেকের মতে এনার নাম থেকেই ঢাকা শহরের নামের উৎপত্তি কিন্তু সেই রাজা যে ইতিহাসের বিখ্যাত বল্লাল-সেন এমনটি নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে ।কতই না কাহিনী কতইনা কিংবদন্তি। কিন্তু ইনি যে ঢাকা জেলার এক ঐতিহ্য একথা সকলেই স্বীকার করবেন।
দেশভাগের ফলে ভিটে হারা শুধু যে মানুষ নন, রয়েছেন অনেক পারিবারিক দেবদেবীরাও যার অন্যতম হলেন এই ঢাকেশ্বরী। ১৯৪৮ সালে এক বিশেষ বিমানে কোনরকমে তাঁকে লুকিয়ে কলকাতায় নিয়ে চলে আসেন রাজেন্দ্রকৃষ্ণ তিওয়ারি বা প্রহ্লাদ তিওয়ারি ও হরিহর চক্রবর্তী। ব্যবসায়ী দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরীর গৃহে ঢাকেশ্বরী দু’বছর যাবৎ পূজিত হতে থাকেন। এরপর ওই ব্যবসায়ী কুমোরটুলির দুর্গা মায়ের মন্দির নির্মাণ করে দেন।অনেকের মতে ক্রিকেটার পঙ্কজ রায়ের পরিবার ও এই মন্দির কে যথেষ্ট সহায়তা করেছিলেন কারণ তাদের ভাগ্যকুলে জমিদারী ছিল।
প্রায় দেড় ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট অষ্টধাতুর ঢাকেশ্বরী মূর্তিটি শিল্প কলার এক অদ্ভুত নিদর্শন। অত্যন্ত সুক্ষভাবে এই মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন নিঃসন্দেহে কোনো দক্ষ শিল্পী। পরিবারসহ অষ্টধাতুর এইরকম মূর্তি প্রায় বিরল বললেই চলে। মায়ের সামনের দুটি হাত পিছনের আটটি হাতের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বড়।তবে গণেশের মূর্তি টি তার সুন্দর রং এর জন্য বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ।ঢাকেশ্বরী মায়ের মাথার উপরে রয়েছেন বৃষবাহনের ওপর মহাদেব।মূর্তিটি সালংকারা এবং বর্তমানে প্রায় প্রতিদিনই একে নতুনভাবে বস্ত্র পরিধান করানো হয়।মন্দিরের বর্তমান পূজা পুরোহিত সঞ্জয় তেওয়ারি তারা বংশপরম্পরায় এই পুজো করে আসছেন।মায়ের প্রতিদিন অন্নভোগ হয় ।এই অন্নভোগ নিতে গেলে আগের দিন মন্দিরে জানিয়ে যেতে হয়।প্রতিদিন ভোর বেলা মন্দির খুলে আর বন্ধ হয় বেলা ১২ টায় আবার বিকেল চারটে থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত। সান্ধ্যকালীন মায়ের আরতি খুবই সুন্দর হয়। মন্দিরে খুব ঘটা করে দুর্গাপুজো হয়।
কলকাতার প্রাচীনতম রাস্তা চিৎপুর রোড ধরে দক্ষিণ থেকে উত্তরে হেঁটে শোভাবাজারের মোড়ে চলে আসুন। সেখান থেকে আর একটু হাঁটলেই কুমোরটুলি, কলকাতার প্রতিমা তৈরির কারখানা। কুমোরটুলির প্রধান রাস্তাটার নাম বনমালী সরকার স্ট্রিট। ওই রাস্তায় ঢুকে ডান দিকে খানিকটা এগিয়ে আরও একটা গলিপথে ঢুকলে, চোখে পড়বে লাল রঙের একটা মন্দির। দেওয়ালের গায়ে স্পষ্ট করে লেখা রয়েছে, ‘শ্রী শ্রী ঁ ঢাকেশ্বরী মাতার মন্দির’। পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে সামনের প্যাসেজে জুতো খুলে মূল মন্দিরের দালানে ওঠা যাবে। বিশাল বর্গাকার দালানের একপ্রান্তে আলাদা একটা শ্বেত পাথর দিয়ে বাঁধানো ঘরে রয়েছে অষ্টধাতুর ঢাকেশ্বরী। দেবী মূর্তির উচ্চতা দেড় ফুটের মতো। দুটো চালি। পিছনের চালিটা ঢাকা থাকে সামনের রুপোর চালিতে। পাশে লক্ষ্মী ও সরস্বতী এবং নীচে কার্তিক ও গণেশ। দেবীর বাহন পৌরাণিক সিংহ। দেবীর সামনের হাতদুটো বড়, পিছনের আটটা হাত কিছুটা ছোট। মূর্তির একপাশে রাম ও হনুমানের মাটির মূর্তি।

Loading comments...